মো. হাসান আলী
কোনো জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে এমন নজির বিশ্বের কোথাও পাওয়া যায় না। বাঙালি জাতি তার মাতৃভাষা রক্ষা দাবিতে জীবন দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে এমন নজির সৃষ্টি হরেছে। তবে একটা গর্বের বিষয় যে, ভাষার জন্য লড়াই করে বাঙালি তার মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মর্যদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু তাই নয় ভাষা রক্ষার আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা এবং ৭১’র মাহান মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধের ইতিহাস যেমন নির্মম তেমনি গৌরবের। এখন ফেব্রæয়ারি ২০২৩ ভাষার মাস। বাংলাদেশের মানুষ নানা আয়োজন নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে থাকে ভাষার মাস। প্রতিবছর ২১ ফেব্রæয়ারি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হচ্ছে। বাঙালির গৌরব গাঁথা এ ইতিহাসের শিক্ষা থেকে উজ্জীবীত হয় আমাদের নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্মকে জানতে এবং শিক্ষা নিতে হবে কি নিহিত আছে সেই মাতৃভাষা আন্দোলনের সত্যনিষ্ট ইতিহাসের গর্ভে। আমার সেই বিষয়েই লেখা সংক্ষিপ্ত এ প্রতিবেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) আপামোর জনতা আন্দোলন করেছিলেন। সেই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। নিজের ভাষায় কথা বলা, কথাশুনা, লেখা, জানা ও মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আন্দোলন, তার জন্য আত্মত্যাগ বাংলা ভাষার জন্য সারা বিশ্বে এটাই প্রথম। ভাষা আন্দোলনের শহীদরা আমাদের জতীয় বীর। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয় তা পরবর্তীকালে পরিপূর্ণতা লাভ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যদিয়ে।
‘ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের অমর শহীদরে সম্পূর্ণ তথ্য উদঘাটন করা আজও সম্ভব হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাষা সৈনিকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী,পুলিশ অনেক লাশ গুম করেছিল। আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল। সেদিন ছাত্র-জনতা ভাষা শহীদদের পরিবার পরিজন কেউ লাশটি পর্যন্ত পায়নি কবর দেওয়ার জন্য। ভাষা শহীদদের কবর হারিয়ে গেছে স্বৈরাচারী শাসকের চক্রান্তে। সাংবাদিকরাও সকল তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এ পর্যন্ত ৬ জন শহীদের নাম পাওয়া গেছে। ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ ২৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ তারিখে প্রকাশিত শহীদ সংখ্যায় ৮জন নিহতের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু তাঁদের পরিচয়াদি প্রখাশ করা হয়নি। ২৩ ফেব্রæয়ারি,১৯৫২ তারিখে দৈনিক আজাদ ৪ জনের বেশি নিহত এবং ঘটনার সঙ্গেসঙ্গে তাদের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কলকাতার ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ পত্রিকায় ৯ জন শহীদ হয়েছে বলে প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় শহীদ দিবস সংখ্যায় ৭ জন শহীদদের পরিচয় তুলে ধারা হয়েছে। সূতরাং সরকারি সহযোঘিতা ছাড়া ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা উদঘাটন করা কঠিন কাজ। নীচে ৭ জন ভাষা শহীদদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিভিন্ন তথ্যসূত্রে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের অমর শহীদ আবুল বরকত, শহীদ আব্দুস সালাম, শহীদ আব্দুল জব্বার, শহীদ মোহাম্মদ রফিক, শহীদ সফিউর রহমান, শহীদ অহিউল্লাহ, শহীদ আব্দুল আওয়াল প্রমুখ।
শহীদ আবুল বরকত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। তিনি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার অন্তর্গত বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মতারিখ ছিল ১৬জুন ১৯২৭। তিনি মৌলভী শামসুদ্দীনের জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁর মায়ের নাম হাসিনা খাতুন। বরকত তালেবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাশের পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার পুরান পল্টন লাইনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে তিনি তাঁর মামার নঙ্গে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শহীদ বরকতকে একুশে পদকে ভ’ষিত করেন।
শহীদ আব্দুস সালাম: শহীদ আব্দুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর। তিনি ছিলেন সরকারি অফিসের একজন পিয়ন। ২১ ফেব্রæয়ারি ঘটনার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে গুলিদ্ধি হন। তখন তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে তিনি ৭ এপ্রিল বেলা ১১ টায় মারা যান। শহীদ আব্দুস সালাম ফেণী জেলার দাগন ভ’ইয়া উপজেলার লবণপুর গ্রামের মো. ফাজিল মিয়ার পুত্র। তাঁর মায়ের নাম দৌলতুন্নেসা। গুলিদ্ধি হওয়ার আগে ঢাকার ৩৬-বি, নীলক্ষেত ব্যারাকে বাস করতেন। তাঁর কোনো কবরের সন্ধান জানা জায়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে শহীদ আব্দুস সালামকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভ’ষিত করেছেন। ফেণীর একমাত্র স্টেডিয়ামটি শহীদ সালামের নামে নমকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আব্দুস সালামের নামে।
শহীদ আব্দুল জব্বার: পেশাগত জীবনে তিনি একজন দর্জি ছিলেন। তাঁর জন্ম তারিখ আনুমানিক ১৯১৯ সালে। তাঁর পিতার নাম হাসেম আলী শেখ ও মায়ের নাম সাফিয়া খাতুন, স্ত্রীর নাম আমেনা থাতুন ও ছেলের নাম নূরুল ইসলাম বাদল। ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ মেডিকেল কলেজের সামনে আব্দুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হন এবং ওই দিন রাত ৮টার সময় হাসপাতালে মারা যান। ১৯৫২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে অআব্দুল জবাবার অসুস্থ্য শ্বাশুড়িকে চিকিৎসার জন্য তিনি ঢাকা আসেন এবং তাঁর পরিচিত ডা. সিরাজুল ইসলামের মাধ্য শ্বাশুড়িকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন এবং হাসপাতাল প্রাঙ্গ ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। একপর্যায় তিনি গুলিব্ধি হন। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার আব্দুল জব্বারকে মরণোত্তর একৃশে পদকে ভ’ষিত করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব এম.এ সামাদ ২০০০ সালে আজিমপুর শহীদ আব্দুল জব্বারের কবরস্থানটি সনাক্ত করার উদ্যোগ নেন। আজিমপুর পুরোনো কবরস্থানে শহীদ বরকতের দশগজ পশ্চিমে শহীদ জব্বারের কবরটি চিহ্নিত করা হয়েছে। শহীদ আব্দুল জব্বারের সমাধিলিপিতে একটি ফলক স্থাপন করা হয়েছে।
শহীদ মোহাম্মদ রফিক: ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের বিষ্ফোণোম্মুখ অবস্থায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারির প্রথম শহীদ মোহাম্মদ রফিক বা রফিকুদ্দীন আহমেদ। এসময় তিনি মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে আইকম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ৫২-র ২১ শে ফেব্রæয়ারি ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে অংশগ্রহণের জন্য রমনায় একত্রিত হন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাসের কারণে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আশ্রয় য়োর সময় শহীদ রফিকের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় এবং সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির আঘাতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। শহীদ রফিকের মরদেহ দাফন করা হয় সংগোপনে আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতে আজিমপুর গোরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায়। বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে শহীদ রফিকুদ্দীনকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভ’ষিত করেন।
শহীদ সফিউর রহমান: অমর শহীদ শফিউর রহমান ঢাকা হাইকোর্টে কর্মরত ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত কোন্মেগর গ্রামে ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মাহবুবুর রহমান। শহীদ শফিউর রহমান কলকাতা গভর্মেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আইকম পাশ করারপর দারিদ্রতার কারণে চাকরি নেন। কিছুদিন চাকরি করারপর পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত হয়। এসময় তিনি তাঁর স্ত্রী আকলি বেগমকে নিয়ে ঢাকা আসেন এবং হাইকোর্টের কেরানি হিসেবে চাকরি করেন। ২২ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ তারিখে সকাল ১০ টায় সাইকেলে চড়ে নবাবপুর রোড হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে একটি রাইফেলের গুলি তাঁর পৃষ্ঠভেদ করে বের হয়ে যায়। এসময় তিনি মটিতে লুটিয়ে পড়েন। সরকারি এ্যাম্বুলেন্স যোগে তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ডা. এ্যালিসনস অপারেশন করেন। ওই দিন সন্ধ্যা সড়ে ৬টার সময় মারা যান তিনি। এসময় তাঁর মা,বাবা, স্ত্রী, মেয়ে শাহানাজ হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। মারা যাবার পর পুলিশ আত্মীয়দের কছে সফিউর রহমানের লাল হস্তান্তর করেনি। জানাজায় তাঁর বাবা ও ভাই উপস্থিত ছিলেন। আজিপুর শহীদ সফিউর রহমানের কবর গাত্রে ভাষা-আন্দোলনে শহীদ সফিউর রহমানের নাম লেখা আছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শফিউর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভ’ষিত করেন।
শহীদ অহিউল্লাহ: ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের তালিকায় একজন আট বছরের নাবালগ ছেলে রয়েছে য়াঁর নাম অহিউল্লাহ। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ছেলে। শহীদ হবার সময় অহিউল্লহ তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। অহিউল্লাহ শহীদ হন ২২ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ তারিখে। ওই দিন নবাবপুর রোডে অনেক সেনা মোতায়েন ছিল। ২১ ফেব্রæয়ারির ঘটনারপর সরকার এ ধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছিল। ঘটনার সময় শহীদ অহিউল্লাহ মনের আনন্দে নবাবপুর রোডের পার্শ্বে ‘খোশমহল’ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ চিবুচ্ছিলেন। আসলে তিনি নবাবপুর রোডদিয়ে জনতার ঢল দেখে কৌতুহলবশত দেখতে এসেছিলেন। এসময় একটি গুলি তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। গুলিতে মারা যাবার পর পুলিশ অহিউল্লাহর লাশ গুম করে ফেলে। কোথায় তঁকে কবর মেয়া হয়েছে আজও জানা যায়নি।
শহীদ আব্দুল আওয়াল: ভাষা শহীদদের তালিকায় আব্দুল আওয়ালের নামটি বরাবর উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ২২ ফেব্রæয়ারি রিক্সাচালক আব্দুল আওয়াল (লাইসেন্স নং-৩৪০২) নিহত হন। ১৪-২৫ মার্চ, ১৯৫২ ইং দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, আব্দুল আওয়ালের পিতার নাম মোহাম্মদ হালিম, বয়স ২৬। মোটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। ১৯নং হাফিজুল্লা লেন মওলভী বাজার ঢাকায় বাস করতো। মারা যাবারপর জানাজা নামাজের সময় তার কোনো আত্মীয় উপস্থিত ছিল না। প্রথাম শ্রেণীর মেজিস্ট্রেট জনাব ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতিতে মাওলানা আব্দুল গফুর তাঁর জানাজা পড়ান। (তথ্যসূত্রঃ ভাষা শহীদদের কথা ও স্বপ্ন-ডাঃ এম.এ মুক্তাদীর: প্রকাশ: ২০ ফেব্রæয়ারি-২০১২ ও ২০ ফেব্রæয়ারি ২০১৫)।
দৈনিক এরোমনি প্রতিদিন ডটকম তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন প্রক্রিয়াধীন অনলাইন নিউজ পোর্টাল