জেবুন্নেছা ববিন
প্রতি বছর ১ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব প্রবীণ দিবস । বাংলাদেশেও পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব প্রবীণ দিবস।প্রবীণ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্যে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা।’ প্রতি বছরই দিবসটির প্রতিপাদ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু ওই একটি দিনেই তা সীমাবদ্ধ থাকে।
প্রবীণরা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটুকু নিরাপদ বা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এ খবর ক’জন রাখেন? প্রবীণরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।
প্রবীণ মানেই আমাদের দাদা দাদী, নানা নানী, মা বাবা, ভাই বোন, চাচা মামা, খালা ফুফু প্রতিবেশি আরও অনেক অনেক সম্পর্কের আত্মীয় পরিজন, স্বজন, বন্ধু। প্রবীণরা প্রতিনিয়ত তাঁরই গড়া পরিবারেই নিগৃহীত হন বেশি। অধিকাংশ পরিবারে প্রবীণদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই।
ষাট বছরের বেশী বয়সী মানুষকে বাংলাদেশে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবে, বাংলাদেশে বতর্মানে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ছয় মাস।
প্রবীণ জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ নিজের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থাটি করতে পারেন না। বিশেষ করে যাদের বয়স সত্তরের বেশি।প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা অবহেলিত হবেন, এটা মেনে নেয়া যায় না।দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭।জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ প্রবীণপ্রবণ সমাজে পদার্পণ করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রবীণপ্রধান সমাজ পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। দ্রুততম সময়ে এই পরিবর্তন ঘটতে চলেছে, বিশ্বে এমন সব দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন রকম সর্বজনীন উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই । অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রবীনদের জন্য রাস্ট্রীয় ভাবে অনেক রকম স্কীম চালু আছে যা অবশ্যই অনুকরণীয়। উল্লেখ্য জার্মানিতে বয়স্ক বা প্রবীণদের জীবনযাত্রা বাংলাদেশের তুলনায় পুরোপুরি ভিন্ন৷ তাঁদের স্বাস্থ্য, হাঁটা-চলা, সাজগোজ দেখলে, কথাবার্তা শুনলে মনেই হয় না যে তাঁরা প্রবীণ৷
জার্মানিতে প্রবীণদের জন্য রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা৷ মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার স্বাস্থ্য, হোক সে তরুণ বা প্রবীণ৷ তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুস্থ থাকা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷
সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিমা, যা কিনা জার্মানির শতকরা ৯০জন নাগরিকেরই রয়েছে৷ প্রবীণদের সুচিকিৎসার নিরাপত্তা থাকায় তাঁরা নিশ্চিন্ত৷ আর থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা তো তাঁদের নেই-ই৷ বয়স্ক যাঁদের পেনশন খুব কম, তাঁদের জন্য সরকারই এগিয়ে আসে ব্যয়ভার বহন করতে৷
জার্মানিতে ৬৫তম জন্মদিনের পরেই সবাই সিনিয়র নাগরিক হিসেবে কিছু বাড়তি সুবিধা পান৷ বাস, ট্রাম, ট্রেন, মিউজিয়াম, কনসার্ট বা খেলা দেখার টিকিটের মতো অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়৷ তাই প্রায়ই প্রবীণদের দল বেঁধে এসব উপভোগ করতে যেতে দেখা যায়৷ আবার
নরওয়ে তে প্রবীণদের ক্ষেত্রে সব বিষয়েই দেশটি র ্যাংকিং এ শীর্ষে।দেশটিতে ৭১ দশমিক ১ ভাগ কর্ম সংস্থান। দেশটিতে প্রবীণদের মধ্যে দরিদ্র ১ দশমিক ৮ ভাগ এবং সে দেশেও ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের শতভাগ পেনশন সুবিধা রয়েছে।
সুইজারল্যান্ডকে ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের জন্য সেরা দেশ বলা হয়ে থাকে। সে দেশে প্রবীণের জন্য সেরা স্বাস্থ্য সেবা রয়েছে। এছাড়া তাদের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ ভালো। ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের শতভাগ পেনশন সুবিধা প্রাপ্ত।
সুইডেনে ষাটোর্ধ্বদের কর্মসংস্থান এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত থাকার হার অনেক বেশি। সেখানে প্রবীণরা নিজেদের নিরাপত্তা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতেই পারে। আমাদের দেশের প্রবীণরা মানসিকতার স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সাথেই থাকতে চান এবং সামাজিকভাবেও সেটাই হয়ে আসছে।তবে সময়ের সাথে সাথে সামাজিক অবস্থা এবং পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট সেবা-ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে আসছে এবং মানুষজন গ্রাম ছেড়ে শহরে বা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেক মা-বাবা বা পারিবারিক অন্যান্য আত্মীয় সম্পর্কের প্রবীণরা অরক্ষিত হয়ে পড়ছেন। এখন সময় হয়েছে ভাববার।
বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য শুধু সরকারি সাহায্যই সীমিত নয়, বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না। অন্ততঃ যতটা হওয়া উচিত ততটা যে হচ্ছে না, সেবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই একমত।
২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে স্বস্তিময় বার্ধক্য দশক হিসেবে পালিত হচ্ছে। সরকারের প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইনটির খসড়া গত প্রায় ১০ বছর হলো আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে। প্রবীণ বিষয়টিকে আর হেলাফেলা করার সুযোগ নেই, সরকারকে তা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরিতে পেনশনের আর্থিক নিরাপত্তা থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারি চাকুরিতে সেটি নেই। এসব মিলিয়ে বার্ধক্যের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, সেটা অনেকেই আমলে নেন না।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হলে ভবিষ্যৎ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। তবে জনসচেতনতা তৈরি, সামাজিক ও পারবারিক মূল্যবোধ, বিনিয়োগ ও পেশাদারিত্ব- সব ক্ষেত্রেই প্রবীণদের জন্য কাজ করতে হবে। আর এ বিষয়ে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
দৈনিক এরোমনি প্রতিদিন ডটকম তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন প্রক্রিয়াধীন অনলাইন নিউজ পোর্টাল